আমার বিভাগে মাত্র ন’জন শিক্ষক! শিক্ষার্থী কম নয়! অনেক! অনেক বেশি! স্নাতক ও স্নাতকোত্তরসহ সাড়ে তিনশতর কাছাকাছি ! আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম, আবাসন, খেলার মাঠ, চিকিৎসা সেবা, যাতায়াত ইত্যাদি! এই সমস্যাগুলো শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র নয়, কম বেশি আমাদের দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র এটি! চিত্রটা দিন দিন প্রশস্ত হচ্ছে! আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি! কখনো সখনো দাবি দাওয়া নিয়ে হাজির হচ্ছি ভিসির দরবারে! তিনি মাঝে মাঝে আমাদের আশ্বস্ত করেন! হবে! সব হবে! সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যায় ভিসি আসে উন্নতি খুব একটা হয় না। কেননা তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে! এটা সময়ের দোষ! এটা সিস্টেমের দোষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, শিক্ষার হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে! মানের প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে!

আমরা দিন দিন মুখোশধারী সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি! এখানে অর্থের লোভ আছে। ক্ষমতায় টিকে থাকবার আকাঙ্ক্ষা আছে। রাজনীতিবিদরাও এখন নীতি পরিবর্তন করছেন। আগে জনগনের মন জয় করতে রাস্তা ঘাট পাকা করবার কথা বলতেন! এখন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপনের কথা বলেন। বাহ! কি সুন্দর নীতি! তারা দু- একবছরের মাঝে সফলও হচ্ছেন। এর বিশেষ কারনও আছে। আইন প্রণেতা তারা। জাতিকে নিরক্ষর মুক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপন করা জরুরি! এভাবেই আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপন হয়। বেকার তৈরির কারখানা তৈরি হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন ৬৬ ভাগ শিক্ষার্থী বেকার। এবং দেশের শতকরা ৪৭ ভাগ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বেকার। এর দায়ভার কেউ নিতে চাই না! কেউ নিবেও না হয়তো। এই উচ্চ শিক্ষিত বেকাররা আবার গ্রামে ফিরে যাবে। কৃষি কাজে মনোনিবেশ করবে। কৃষিখাতও তেমন উন্নত নয়।

আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়! ৫০ অতিক্রম করেছে। গুনগত মান নিয়ে প্রতিবছর প্রশ্ন ওঠে! বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং এর তালিকায় আমরা প্রতিবছর অনেক পিছিয়ে থাকি! ৫ শত এর মাঝেও আমাদের অবস্হান নেই। এর দায়ভার অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের উপর এসে বর্তায়। নীতি নির্ধারকদের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা গবেষণা মুখী নন। কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়। বরাদ্দের অপ্রতুলতা এর অন্যতম কারণ! ১৯৬৮ সালে জাতিসংঘ ঘোষণা দিয়েছিলো, যদি কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্হাকে উন্নতি করতে হয়, তাহলে সেই দেশের জাতীয় আয়ের (জিডিপির) শতকরা ৬ ভাগ ব্যয় করতে হবে! আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের মাত্র ২-৩ ভাগ, যা নিতান্তই কম। আবার শিক্ষকদের বেতন কাঠামো খুব একটা উচ্চমানের নয়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন অনেক নিম্নমানের এবং সুযোগ সুবিধাও খুব একটা ভালো নয়।

বিচারপতি হামিদুর রহমান বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় অর্জিত জ্ঞানের গুদাম মাত্র নয়। এটি একটি প্রতিষ্ঠান যাকে জাতির ভবিষ্যত নির্মাতাদের জতুগৃহ বলা হয়।’ এই জতুগৃহের খুটি নড়েবড়ে! হালকা বাতাসেও দোল খায়! শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থীরাও এর বাইরে নয়! আমরা মাঝে মাঝে শিক্ষকদের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলি! আবার এটাও আমাদের ভাবা উচিত তাদের মানোন্নয়নে নীতি নির্ধারকদের ভূমিকা কি! এবং কি শিক্ষকদেরও যে শিক্ষার প্রয়োজন আছে তা হয়তো নীতি নির্ধারকরা ভুলে যান। তাদের গবেষণামুখী করবার জন্য বেতনের বাইরেও আলাদা কোনো বরাদ্দ আছে কিনা! হয়তো আছে যা নিতান্তই অপ্রতুল ! গত ২৬ জানুয়ারি ২০২২ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দৈনিক গড় পুষ্টি প্রয়োজন ২৮,০০-৩,০০০ কিলোক্যালরি অথচ হলের খাবারে একজন শিক্ষার্থী দৈনিক গড়ে পুষ্টি পান ১,৮২১ কিলোক্যালরি। আবার শিক্ষার্থীরাও হলের নিম্নমানের খাবার খেয়ে ঠিক কতটুকু নিজেকে বিকশিত করতে পারবে তা ভাববার বিষয়।

হয়তো আমাদের এখন থামা উচিত! হয়তো অনেকে ভাববেন দেশে শিক্ষা বিপ্লব চলছে। তবে এই বিপ্লব খুব একটা সফল বয়ে আনবে না! কেননা বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যায় না বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুনগত মান নিয়ে কাজ করা উচিত। যে কটি বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে আছে, সেগুলোকেই বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে নীতি নির্ধারকদের ভূমিকা থাকা উচিত। নচেৎ আমরা অনেক পিছিয়ে পড়বো!

লেখক- মনিরুল ইসলাম মুকুল, শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।